একসময় বিয়ের কথাবার্তা পাকা হলেই ডাক পড়ত পালকিওয়ালার। লাল শাড়িতে লাজুক হেসে কনে বসতেন পালকিতে, পাশে পাশে ঘোড়ায় চেপে চলতেন বর। গ্রামীণ পরিবেশ আর পালকি চড়ে বউ যাচ্ছেন তার শ্বশুরবাড়ি। গ্রামবাংলার এমন ঐতিহ্যে এখন প্রায় হারিয়ে যাওয়ার পথে।
বুধবার (১৭ নভেম্বর) ভোলায় এক বিয়েতে লাল শেরওয়ানি, মাথায় পাগড়ি পরে সুসজ্জিত ঘোড়ায় চড়ে কনের বাড়িতে গেলেন এক বর। ফিরে এলেন একইভাবে। তবে বাড়ি ফেরার পথে সহযাত্রী নববধূ আসেন পালকিতে চেপে। ভোলা সদর উপজেলার ধনিয়া ইউনিয়নের নবীপুর গ্রামে ব্যতিক্রমী এ বিয়ে অনুষ্ঠিত হয়।
জেলা শহরের পৌরসভার ২ নম্বর ওয়ার্ডের গাজীপুর রোডের মো. আকবর হোসেন ছেলে মো. আনোয়ারুল আজিম। তিনি ঢাকা পাসপোর্ট অফিসে কর্মরত আছেন। ছোটবেলা থেকেই শখ নিজের বিয়ের দিনটিকে স্মরণীয় করে রাখবেন। আর এজন্য তিনি ঘোড়ায় চড়ে শ্বশুরবাড়ি যাবেন। আর পালকিতে করে আনবেন প্রিয়তমাকে। পাশাপাশি গ্রাম বাংলার যে ঐতিহ্য, সেই ঐতিহ্য যেন নতুন প্রজন্মের কাছে পৌঁছে দেবেন।
বুধবার বিকেলে পারিবারিকভাবে একই উপজেলার পাশের নবিপুর গ্রামে বিয়ে করেন আজিম। উভয় পরিবার আজিমের শখ পূরণে এবং বিলুপ্ত প্রায় গ্রামীণ সংস্কৃতিকে ধরে রাখতে ব্যতিক্রমী এ বিয়ের আয়োজন করেন। কনে নবীপুর গ্রামের মো. লোকমানের কন্যা সুমাইয়া আক্তার ইমা। তিনি ভোলা সরকারি মহিলা কলেজে পড়াশোনা করছেন।
দুপুরে ঘোড়ায় চড়ে নিজ বাড়ি থেকে শ্বশুরবাড়ির উদ্দেশে যাত্রা করেন। ঘোড়ায় চড়ে মেঠো পথ মাড়িয়ে দুই কিলোমিটার দূরে নবীপুর গ্রামে যান বর আজিম। সেখানে শুরু হয় বিয়ের সব আনুষ্ঠানিকতা। চলে বরযাত্রীদের মধ্যাহ্ন ভোজন। সব শেষে পালকিতে করে বউ নিয়ে বাড়ি ফেরেন তিনি।
বিয়েবাড়িতে আসা বরযাত্রী মো. নিয়াজ মোর্শেদ জানান, যান্ত্রিক বাহনের কারণে এখন আর বিয়েতে পালকি ব্যবহার হয় না। কিন্তু এটা আমাদের গ্রামবাংলার চিরায়ত ঐতিহ্য। এই ঐতিহ্য যেন গ্রামবাংলার ঘরে ঘরে ফিরে আসে এটাই আমরা চাই।
বিয়েতে আসা ষাটোর্ধ্ব বৃদ্ধ শানু মিয়া জানান, আমাদের সময় শ্বশুরবাড়িতে বউ আসা-যাওয়া করত পালকিতে। কনেপক্ষের লোকেরা পালকি ছাড়া তাদের মেয়ে কখনোই তুলে দিতে চাইতেন না। তাই আগে থেকেই পালকি বায়না করে বিয়ের দিন তারিখ ঠিক করা হতো। কালের বিবর্তনে সেই পালকি আমাদের সমাজ থেকে হারিয়ে গেছে। এখন আবার আজকে এই বিয়েতে পালকি দেখে খুব ভালো লাগছে। এখন আমাদের ছেলেপেলে নাতি-নাতনিদের দেখাতে পারব কোন এক সময় এই পালকিতে আমাদের বিয়ে হত ।
বিয়েবাড়িতে আসা কনের বোন ইমা ও সোহানা জানান, আমাদের গ্রাম বাংলার ঐতিহ্য আমরা ফিরিয়ে আনতে পেরেছি দেখে খুব ভালো লাগছে। আমার বোনকে পালকিতে করে তার শ্বশুরবাড়ি নেওয়া হচ্ছে। বিষয়টি সত্যিই খুব আনন্দের। আমরা চাই আমাদের প্রজন্ম যেন এই পালকি সংস্কৃতি ধরে রাখতে পারে। এবং ভবিষ্যতে বিয়েতে যেন পালকিতে কনেকে শ্বশুরবাড়ি নেওয়া হয়।
এমন আয়োজন করতে পেরে মহাখুশি বর আনোয়ারুল আজিম। তিনি বলেন, শখ থেকেই এমন আয়োজন। বিয়ের দিনটিকে স্মরণ রাখতেই ঘোড়া-পালকিতে বিয়ে। শখের পাশাপাশি গ্রামীণ সংস্কৃতি ধরে রাখতেই ব্যতিক্রমী এ আয়োজন। পাশাপাশি তার দেখাদেখি নতুন প্রজন্মের মধ্যে এই পালকির চল ছড়িয়ে পড়বে এমন টাই আশা করেন তিনি।
আজিম আরও জানান, ঘোড়া, পালকি ও পালকির বেহারা সংগ্রহ করতে তাকে বেশ বেগ পেতে হয়েছে। এরপরও হারানো ঐতিহ্যে জীবনের বিশেষ দিনটিকে স্মরণীয় করে রাখতে পেরে তিনি উচ্ছ্বসিত বলেও জানিয়েছেন।